গল্প- অবিনাশ হৃদয়ে বাঁচো

অবিনাশ হৃদয়ে বাঁচো
– ডাঃ তারক মজুমদার

 

 

ওয়েনড্রিলা যথারীতি খেঁকিয়ে উঠে অবিনাশকে বললো- “তোমার মত লেখক কবিকে ওই রকম লোকেরাই সম্মান জানায়”। বলার মধ্যে অবিনাশ শুধু বলেছিল- “জানোতো ওয়েনড্রিলা, ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯ (দঃ)২৪পরগনার একটি সাহিত্য সংস্থা আমায় “বঙ্গ সন্তান সম্মান২০১৯”এ ভূষিত করবেন। ব্যাস আর যায় কোথায়? সাথে সাথেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেই ওয়েনড্রিলা, যা না তাই বলে অবিনাশকে অপমান জনক কথা বলে তিরবিদ্ধ করতে লাগলো। আসলে অবিনাশের বউ আর ছেলে কোন দিনই অবিনাশের সাহিত্যচর্চাকে ভালো চোখে দেখেনি। কটূক্তি,অস্রাব্য কথা এখন অবিনাশের নিত্য দিনের পাওনা। কী নিদারুণ পাষাণ চাপা দিয়ে বুকে, কত শত অবজ্ঞা, জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে যে অবিনাশ সাহিত্যচর্চা করে চলেছে, তা ঈশ্বর আর অবিনাশ ছাড়া কেউ জানে না।

অবিনাশের সৃজনশীল সাহিত্যসৃষ্টির নৈপুণ্যে পঃবঃ তথা ভারতবর্ষের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ চিন জাপান তেহেরান জার্মানি আমেরিকা ফিলিপাইন্সে ও প্রচুর পরিচিতি। সাহিত্য এবং চিকিৎসা সূত্রেই। বাড়িতে কাগজ কলম নিয়ে বসবার সে সুযোগ নেই অবিনাশের। যেটুকু লেখে চেম্বারে রোগী দেখার অবসরে। ওয়েনড্রিলা মাঝে মাঝে অবিনাশকে হুশকিও দেয়- “এই সমস্ত ছাইপাঁশ, পত্র পত্রিকা, লেখালেখির খাতা, ডায়েরি আজ ছেলেটাকে দিয়ে সব বিক্রি করে দেবো, নয়তো পিন্ডির লেখা আজই সব চিতায় তুলে দেবো।”

অবিনাশ চেম্বারে বেরনোর সময় ওয়েনড্রিলার এমন উগ্র চন্ডীমূর্তি আর অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর বুকের ভিতরটা আজ কেন যেন এক অদৃশ্য আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। দু’চোখ দিয়ে শ্রাবণ ধারা ঝরে পড়ছে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে চেম্বারের উদ্দ্যেশে রওনা হয়। ওদের দেখে শুনে বিয়ে। ওয়েনড্রিলা বিয়ের আগে ভালো করে জেনে শুনেই অবিনাশের সাথে এই বিয়েতে সন্মতি দিয়েছিল। অবিনাশ যে সাহিত্য চর্চা করতো ওয়েনড্রিলা সব জানতো। অথচ বিয়ের পর থেকেই অবিনাশের সাহিত্যচর্চায় বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।

অবিনাশ এখন আসল কথাটা বুঝতে পেরেছে যে, সাহিত্যকে সকলেই ভালোবাসে না। মর্যাদাও দিতে পারে না। আর এই ধরনের অবজ্ঞা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আমাদের মত মানুষদের বাড়ি থেকেই শুরু হয়। যাদের কাছে শাড়ী গহনা অর্থই সব কিছু, তারা মানুষকে কী করে ভালবাসতে পারবে? মানুষের শরীর স্পর্শ করা খুব সহজ, কিন্তু তার হৃদয় স্পর্শ করা ততোধিক কঠিন কাজ।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অবিনাশ ব্যারাকপুর রেল স্টেশানের উদ্দ্যেশে ছুট ছিল রেল লাইন ধরে। মাথায় তখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওয়েনড্রিলার সেই রনচন্ডী মূর্তি তার সাথে অশ্রাব্য কথাবার্তাগুলো- “বই খাতা লেখালেখি পত্রপত্রিকা আজ সব চিতায় তুলবো। তোর মত কবিকে ওই রকম লোকেরাই সম্মান জানায়…” অবিনাশের পিছনে তখন দৈত্যের মত ছুটে আসছে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। হুইসেলের পর হুইসেল। সে শব্দ আর অবিনাশের কর্ণ কুহরে পৌঁছোলো না। অবিনাশকে নিমেষের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত করে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস অদৃশ্য হয়ে গেল। অবিনাশের নিথর দেহের সাথে পড়ে রইল একরাশ উপেক্ষা, অনাদর, ঘৃণা, অবজ্ঞা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বারি বর্ষণ অদৃশ্যভাবে, যা বাড়ি থেকে ওর উপর বর্ষিত হতো প্রতিনিয়ত। অবিনাশ বাড়ির সবাইকে মুক্তি দিয়ে গেল, এই উলঙ্গ সমাজে, উন্মুক্ত আকাশের নিচে নিজে চির মুক্তি পেয়ে।

Loading

Leave A Comment